ইংরেজি বড়ই বিড়ম্বনাদায়ক ভাষা। পড়তে গেলে ঝামেলা। বলতে গেলেও বড় ঝামেলা।
তবে শুনতে গেলে আর কোনো ঝামেলা নেই। তখন হিব্রু, তামিল, ইংরেজি-মানে
বাংলা ছাড়া দুনিয়ার আর সব ভাষা একই রকম মনে হয়।
তবে পেটের দায়ে এখন ওই ইংরেজিকেই সমঝে-সামলে চলতে হয়। যারা এই ভাষাটায় কথা বলে, তাদের সামনে পড়ে প্রায়ই মনে মনে কাতরাতে থাকি, ‘হা, ওপরওয়ালা! কেন বাংলা ছাড়াও কথা বলার উপায় বের করেছিলে?’ ওপরওয়ালা জবাব দেন না। জবাব দিলেন আমার চাকরির ওপরওয়ালা-উৎপল শুভ্র। ডেভ হোয়াটমোরের কথা বুঝতে কষ্ট হয়েছে শুনে হাসলেন। বললেন, ‘এতেই কাতরাচ্ছ বাছা? ডেভ তো শ্রীলঙ্কার খেয়েপরে বেশ এশিয়ান কেতার ইংরেজি বলেন। টের পাবে সত্যিকারের অস্ট্রেলীয়র ইংরেজির হাতে পড়লে!’ এতেও ঠিকমতো ভয় পেলাম কি না, নিশ্চিত হতে পারলেন না। দিন কয়েক পরে হাতে একটা লেখা ধরিয়ে দিলেন। একটা গল্প। বললেন, হাসির গল্প।
আমার কাছে ‘হরর’ গল্প মনে হলো। এক ভারতীয় ক্রিকেটার প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া গেছেন। স্বাগতিকদের মধ্যে কে যেন শুধিয়েছে, ‘এখানে মরতে এসেছে (কাম হেয়ার টু ডাই)?’ বুঝুন অবস্থাটা! মরার এই প্রস্তাব পেয়ে ভয়েই মরার জোগাড় বেচারা। বলেন, ‘না ভাই! না ভাই!’ কিসের না ভাই! ‘আমি তো শুনলাম তুমি মরতেই এসেছ!’ ক্রিকেটারটির পালানোর আগেই ভারতের তখনকার অধিনায়ক বিষেন সিং বেদি বললেন, ‘তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?’ মানে বেদিও মরার দলে? নাহ্। আসলে নাকি অস্ট্রেলীয় ওই ভদ্রলোক বলেছেন, ‘তুমি আজ এসেছ-টু ডে?’ অস্ট্রেলীয়র মুখে পড়ে ‘টু ডাই’ হয়ে গেছে!
উদ্দেশ্য সার্থক। আমি ইংরেজিকে আগেই ভয় পেতাম। তার মধ্যে এবার ‘অস্ট্রেলীয় ইংরেজি’র আতঙ্কে দিন গুজরান করতে থাকলাম। মানে বনে বাঘ আছে জেনে গিয়ে সিংহেরও ভয় পাওয়া আর কি! ততক্ষণে আমার অবশ্য ‘রাম মারুক আর রাবণ মারুক’ অবস্থা। ইংরেজি বলেই তো ভয় দেবে, অস্ট্রেলীয় হোক আর সাইবেরীয়।
তাই যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে চলে গেলাম টিম মের সামনে। এই ভদ্রলোক অস্ট্রেলিয়ার সাবেক স্পিনার। বাংলাদেশে মে এসেছেন ক্রিকেটারদের সংগঠন গড়তে। তাঁর সংবাদ সম্মেলনে যেতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে সংবাদ যত না হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ‘রিফ্রেশমেন্ট’ (খাওয়ার কথা সোজা বাংলায় বললে কেমন শোনায় না!)।
দ্বিতীয়টির ওপর বেশি টান থাকায় গেলাম টিম মের সংবাদ সম্মেলনে। মে আর জুন-যা-ই হোক না কেন, গেলাম। কল্পনার একটুও এদিক-ওদিক হলো না। বিপদ তৈরি হলোই। বিধির কী বিধান, বিপদে পড়লেন মে!
ইদানীং বেশি বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে বলে এক সাংবাদিক শুধালেন, ‘বেশি ক্রিকেট খেলা ব্যাপারটা কি তোমাকে কষ্ট (হার্ট) দেয়?’ ওই ‘হার্ট’ নিয়েই লাগল গোল। ‘হার্ট’ শব্দটা আর বোঝেন না মে। একবার বুঝলেন। সেবার ধরে নিলেন, এ ‘হার্ট’ মানে হৃদয়! উপায় না পেয়ে সামনে হাঁটু গেড়ে বসা বিবিসির হাসান মাসুদও বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন (আসন না পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন, বিনয়ের দাপটে না)। কে বোঝে কার কথা! ততক্ষণে বোঝা গেছে, সমস্যাটা টিম মেরই। বিবিসি তো আর আমাদের মতো বাংলায় ইংরেজি বলে না।
কোনোভাবেই মেকে ‘হার্ট’ করা যাচ্ছে না। কাঁহাতক সহ্য করা যায়? এক সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে, দুই হাত তুলে খাঁটি বাংলায় বললেন, ‘ভাই, তুই কি ব্যথা পাইছস?’ (ইংরেজিতে তুমি, তুই-সব এক বলে ‘তুই’টাকেই বেছে নিলেন?) বিগলিত হাসিটা দেখে মনে হলো, এবার কিছু বুঝেছেন মে।
দেখুন, টিম মেও ইংরেজির চেয়ে বাংলা ভালো বোঝেন!
************************
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০০৮
তবে পেটের দায়ে এখন ওই ইংরেজিকেই সমঝে-সামলে চলতে হয়। যারা এই ভাষাটায় কথা বলে, তাদের সামনে পড়ে প্রায়ই মনে মনে কাতরাতে থাকি, ‘হা, ওপরওয়ালা! কেন বাংলা ছাড়াও কথা বলার উপায় বের করেছিলে?’ ওপরওয়ালা জবাব দেন না। জবাব দিলেন আমার চাকরির ওপরওয়ালা-উৎপল শুভ্র। ডেভ হোয়াটমোরের কথা বুঝতে কষ্ট হয়েছে শুনে হাসলেন। বললেন, ‘এতেই কাতরাচ্ছ বাছা? ডেভ তো শ্রীলঙ্কার খেয়েপরে বেশ এশিয়ান কেতার ইংরেজি বলেন। টের পাবে সত্যিকারের অস্ট্রেলীয়র ইংরেজির হাতে পড়লে!’ এতেও ঠিকমতো ভয় পেলাম কি না, নিশ্চিত হতে পারলেন না। দিন কয়েক পরে হাতে একটা লেখা ধরিয়ে দিলেন। একটা গল্প। বললেন, হাসির গল্প।
আমার কাছে ‘হরর’ গল্প মনে হলো। এক ভারতীয় ক্রিকেটার প্রথমবারের মতো অস্ট্রেলিয়া গেছেন। স্বাগতিকদের মধ্যে কে যেন শুধিয়েছে, ‘এখানে মরতে এসেছে (কাম হেয়ার টু ডাই)?’ বুঝুন অবস্থাটা! মরার এই প্রস্তাব পেয়ে ভয়েই মরার জোগাড় বেচারা। বলেন, ‘না ভাই! না ভাই!’ কিসের না ভাই! ‘আমি তো শুনলাম তুমি মরতেই এসেছ!’ ক্রিকেটারটির পালানোর আগেই ভারতের তখনকার অধিনায়ক বিষেন সিং বেদি বললেন, ‘তুই ভয় পাচ্ছিস কেন?’ মানে বেদিও মরার দলে? নাহ্। আসলে নাকি অস্ট্রেলীয় ওই ভদ্রলোক বলেছেন, ‘তুমি আজ এসেছ-টু ডে?’ অস্ট্রেলীয়র মুখে পড়ে ‘টু ডাই’ হয়ে গেছে!
উদ্দেশ্য সার্থক। আমি ইংরেজিকে আগেই ভয় পেতাম। তার মধ্যে এবার ‘অস্ট্রেলীয় ইংরেজি’র আতঙ্কে দিন গুজরান করতে থাকলাম। মানে বনে বাঘ আছে জেনে গিয়ে সিংহেরও ভয় পাওয়া আর কি! ততক্ষণে আমার অবশ্য ‘রাম মারুক আর রাবণ মারুক’ অবস্থা। ইংরেজি বলেই তো ভয় দেবে, অস্ট্রেলীয় হোক আর সাইবেরীয়।
তাই যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে চলে গেলাম টিম মের সামনে। এই ভদ্রলোক অস্ট্রেলিয়ার সাবেক স্পিনার। বাংলাদেশে মে এসেছেন ক্রিকেটারদের সংগঠন গড়তে। তাঁর সংবাদ সম্মেলনে যেতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে সংবাদ যত না হয়, তার চেয়ে বেশি হয় ‘রিফ্রেশমেন্ট’ (খাওয়ার কথা সোজা বাংলায় বললে কেমন শোনায় না!)।
দ্বিতীয়টির ওপর বেশি টান থাকায় গেলাম টিম মের সংবাদ সম্মেলনে। মে আর জুন-যা-ই হোক না কেন, গেলাম। কল্পনার একটুও এদিক-ওদিক হলো না। বিপদ তৈরি হলোই। বিধির কী বিধান, বিপদে পড়লেন মে!
ইদানীং বেশি বেশি ক্রিকেট খেলা হচ্ছে বলে এক সাংবাদিক শুধালেন, ‘বেশি ক্রিকেট খেলা ব্যাপারটা কি তোমাকে কষ্ট (হার্ট) দেয়?’ ওই ‘হার্ট’ নিয়েই লাগল গোল। ‘হার্ট’ শব্দটা আর বোঝেন না মে। একবার বুঝলেন। সেবার ধরে নিলেন, এ ‘হার্ট’ মানে হৃদয়! উপায় না পেয়ে সামনে হাঁটু গেড়ে বসা বিবিসির হাসান মাসুদও বোঝানোর চেষ্টা করতে লাগলেন (আসন না পেয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন, বিনয়ের দাপটে না)। কে বোঝে কার কথা! ততক্ষণে বোঝা গেছে, সমস্যাটা টিম মেরই। বিবিসি তো আর আমাদের মতো বাংলায় ইংরেজি বলে না।
কোনোভাবেই মেকে ‘হার্ট’ করা যাচ্ছে না। কাঁহাতক সহ্য করা যায়? এক সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে, দুই হাত তুলে খাঁটি বাংলায় বললেন, ‘ভাই, তুই কি ব্যথা পাইছস?’ (ইংরেজিতে তুমি, তুই-সব এক বলে ‘তুই’টাকেই বেছে নিলেন?) বিগলিত হাসিটা দেখে মনে হলো, এবার কিছু বুঝেছেন মে।
দেখুন, টিম মেও ইংরেজির চেয়ে বাংলা ভালো বোঝেন!
************************
দেবব্রত মুখোপাধ্যায়
দৈনিক প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০০৮