সত্যব্রত বড়ুয়া
এক সময় আমার ধারণা ছিল ‘পাগলে কি না বলে, ছাগলের কিনা খায়’ কথাটি স্থায়ী সত্য। এখন মনে হয় অস্থায়ী সত্য। আমি যদি বলি আমার কথা অভ্রান্ত, তবে অনেকেই এটাকে বলবেন, ‘পাগলের
প্রলাপ’। আমি মনে করি পাগল কখনও প্রলাপ বকে না। প্রলাপ বকি আমরাই। আমার
মতো সাধারণ মানুষেরা প্রলাপ বকে বউ এর সাথে ঝগড়া করবার সময়। প্রেমিক-প্রেমিকারা
প্রলাপ প্রেম নিবেদনের সময়। ‘ঐতিহাসিক জনসভায়’ প্রলাপ বকেন রাজনীতিবিদগণ।
পণ্ডিত বাবারা যখন মূর্খ সন্তানদের উপদেশ বর্ষণ করেন তখন সেসবও হয়ে যায়
প্রলাপ। আমরা প্রলাপ বকি ১০৫ ডিগ্রী জ্বর উঠলেও। ‘পাগলে কিনা বলে ছাগলে কি
না খায়’ কথাটির এখন পরিবর্তন করা প্রয়োজন। এর জায়গায় আমরা বলতে পারি ‘ভালো
মানুষ কি না বলে, গরু কি না খায়।’ আমরা ভালো মানুষরাইতো বেহুঁস হয়ে স্থান, কাল, পাত্র
বিবেচনা না করে ভালো কতা বলে হাস্যস্পদ হই। পাগলরা আমাদের মতো পাগলামি করে
না। আজকালকার পাগলরা হুঁসের পাগল। পাগলামি করলেও স্থান কালপাত্র বিবেচনা
করে পাগলামি করে। ছাগলের বেলাতেও একথা বলা যায়। এখনকার ছাগলরা আর আগের মতো
ছাগলামি করে যা ইচ্ছে তা খায় না।
আধুনিক ছাগলরা বুঝে সুঝে খায়। গাছের পাতা শুঁকেই বুঝতে পারে কোনটি খেলে পেট ব্যথা করবে আর কোনটি খেলে করবে না। আগের গরুরা বাজ-বিচার করে খেতো। এখনকার আধুনিক গরুরা যা ইচ্ছে তা খায়। এরজন্য এদের আমরা ছেলেদের লুঙ্গি, মেয়েদের শাড়ি, পলিথিন খেতে দেখি। গরু আধুনিক হলেও বোধের দিক দিয়ে এখনও গরুই রয়ে গেছে। ‘সীবীচের’ ধারে কাছের গরুগুলো ‘বীচে’র হাওয়া খায়। ‘ডিসি হিল এলাকার গরুরা হাওয়া খায় ‘মনিংওয়ার্ক’ করবার সময়। আমার মনে হয় আমাদের অনেক ধারণাই এখন বাতিল যোগ্য হয়ে গেছে। দেখে শুনে, ঠকে-ঠেকে অনেক ধারণাই আমি পরিবর্তন করে ফেলেছি। আগে প্রায়শই বলতাম ‘অস্ত্রের চেয়ে কলম শক্তিশালী’ কথাটি। এখন বলি ‘অস্ত্রের চেয়ে কথা শক্তিশালী।’ কথা দিয়ে বোধহীন শিশুকে যেমন ভোলানো যায় তেমনি ভোলানো যায় বোদ্ধা মানুষকেও। কথার জোরে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করা যায়। সুন্দর করে কথা বলতে জানলে অসুন্দর মানুষও হয়ে যায় সুন্দর। একটি কথা রয়েছে ‘বেশী শুন, কম কথা বলো কিন্তু কাজ করে বেশী।’ আমি বলি, ‘কম শুন, বেশী কথা বলবে এবং এর সাথে করবে বেশী কাজও।’ বেশী শুনে দেখেছি যে শেষে নিজের কথা বলার সুযোগই আর পাওয়া যায় না। সমাজের কল্যাণ করতে হলে আপনাকে ভালো কাজের কথা বেশী করেই বলতে হবে। কথা কম বললে এটা আপনি করতে পারবেন না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে এ জন্যেই ‘গলা চর্চার কথা উচ্চ কক্তে বলা হয়েছে। এখন আমি নিয়ন্ত্রণপত্রের খামে প্রাপকের জায়গায় লিখি শ্রীমতি ও শ্রী.. । অথবা লিখি মিসেস এন্ড মিস্টার...। আগের মতো শ্রী বা মি. দিয়ে শুরু করি না। বলা হয়ে থাকে গাধা পেটালে মানুষ হয় না’ কিন্তু এর সাথে বলা উচিত মানুষ পেটালে গাধা হয় কথাটি। বুদ্ধিজীবী কথাটা যখন শুনি তখন মনে হয় যারা বুদ্ধি বেচে জীবন নির্বাহ করে তারাই বুদ্ধিজীবী। তর্ক করতে ইচ্ছে হয় মাতৃভূমি কথাটি নিয়ে। এ ভূমি কি তবে পিতার নয়? মেয়েরা সব সময়ই বলে থাকে তারা ‘দশ মাস দশদিন’ সন্তানকে কষ্ট করে পেটে ধারণ করে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও ছেলেদের পক্ষে কখনও পেটে সন্তান ধারণ করা সম্ভব নয়। সুযোগ থাকলে ছেলেরা নিশ্চয়ই মেয়েদের সন্তান ধারণের কষ্টে লাঘব করবার জন্যে ভাগাভাগি করে (পাঁচমাস পাঁচ দিন করে) সন্তানকে পেটে ধারণ করতো। আমরা প্রবীণরা প্রায় সময়েই অতীত প্রিয়তার জন্য অচল জিনিসকে কথা দিয়ে সচল রাখতে চাই।’ বুদ্ধির ঢেঁকি কথাটিও সেরকম। আমি ভড়কে গিয়েছিলাম যখন একটা কম বয়সী ছেলে আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো যে ‘ঢেঁকি জিনিসটি কি। আমি অনেক কায়দা কসরৎ করেও ছেলেটিকে ঢেঁকি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেনি। এমন কিছু কথা রয়েছে যা আমরা নির্দ্ধিধায় উৎসাহের সাথে বলে থাকি। এর মধ্যে একটি হলো ‘ঘুষ খাওয়া’ কথাটি। সেদিন আমার এক পুরনো বন্ধু আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। অনেক কাল পরে দেখা তাই দু’জনেই মনের আনন্দে বকবক করছিলাম। আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিলো ‘ঘুষ খাওয়া’ নিয়ে। আমরা বারবার ‘ঘুষ খাওয়া’ কথাটি বলছিলাম। আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী নাতনী মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিলো। এক সময় আমার কাছে এসে সে আবদার করে বললো, ‘দাদু আমি ঘুষ খাবো’। সে চকলেটের মতো ঘুষকেও একটা খাবার মনে করেছিলো। আমার মনে হয় আমাদের এ দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা হলো ‘ঘুষ’। ঘুষ কথাটি এখনও বাতিল যোগ্য কথা হয়নি, কিন্তু এখনও আমরা অনেক বাতিলযোগ্য কথা ব্যবহার করে চলেছি। মাঝে মাঝে ভাবি নিজেও বাতিলযোগ্য মানুষ হয়ে গেলাম কিনা। লেখক: রম্যসাহিত্যিক
source:
http://www.dainikazadi.org/details2.php?news_id=2304&table=june2012&date=2012-06-21&page_id=25
আধুনিক ছাগলরা বুঝে সুঝে খায়। গাছের পাতা শুঁকেই বুঝতে পারে কোনটি খেলে পেট ব্যথা করবে আর কোনটি খেলে করবে না। আগের গরুরা বাজ-বিচার করে খেতো। এখনকার আধুনিক গরুরা যা ইচ্ছে তা খায়। এরজন্য এদের আমরা ছেলেদের লুঙ্গি, মেয়েদের শাড়ি, পলিথিন খেতে দেখি। গরু আধুনিক হলেও বোধের দিক দিয়ে এখনও গরুই রয়ে গেছে। ‘সীবীচের’ ধারে কাছের গরুগুলো ‘বীচে’র হাওয়া খায়। ‘ডিসি হিল এলাকার গরুরা হাওয়া খায় ‘মনিংওয়ার্ক’ করবার সময়। আমার মনে হয় আমাদের অনেক ধারণাই এখন বাতিল যোগ্য হয়ে গেছে। দেখে শুনে, ঠকে-ঠেকে অনেক ধারণাই আমি পরিবর্তন করে ফেলেছি। আগে প্রায়শই বলতাম ‘অস্ত্রের চেয়ে কলম শক্তিশালী’ কথাটি। এখন বলি ‘অস্ত্রের চেয়ে কথা শক্তিশালী।’ কথা দিয়ে বোধহীন শিশুকে যেমন ভোলানো যায় তেমনি ভোলানো যায় বোদ্ধা মানুষকেও। কথার জোরে সত্যকে মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য করা যায়। সুন্দর করে কথা বলতে জানলে অসুন্দর মানুষও হয়ে যায় সুন্দর। একটি কথা রয়েছে ‘বেশী শুন, কম কথা বলো কিন্তু কাজ করে বেশী।’ আমি বলি, ‘কম শুন, বেশী কথা বলবে এবং এর সাথে করবে বেশী কাজও।’ বেশী শুনে দেখেছি যে শেষে নিজের কথা বলার সুযোগই আর পাওয়া যায় না। সমাজের কল্যাণ করতে হলে আপনাকে ভালো কাজের কথা বেশী করেই বলতে হবে। কথা কম বললে এটা আপনি করতে পারবেন না। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে এ জন্যেই ‘গলা চর্চার কথা উচ্চ কক্তে বলা হয়েছে। এখন আমি নিয়ন্ত্রণপত্রের খামে প্রাপকের জায়গায় লিখি শ্রীমতি ও শ্রী.. । অথবা লিখি মিসেস এন্ড মিস্টার...। আগের মতো শ্রী বা মি. দিয়ে শুরু করি না। বলা হয়ে থাকে গাধা পেটালে মানুষ হয় না’ কিন্তু এর সাথে বলা উচিত মানুষ পেটালে গাধা হয় কথাটি। বুদ্ধিজীবী কথাটা যখন শুনি তখন মনে হয় যারা বুদ্ধি বেচে জীবন নির্বাহ করে তারাই বুদ্ধিজীবী। তর্ক করতে ইচ্ছে হয় মাতৃভূমি কথাটি নিয়ে। এ ভূমি কি তবে পিতার নয়? মেয়েরা সব সময়ই বলে থাকে তারা ‘দশ মাস দশদিন’ সন্তানকে কষ্ট করে পেটে ধারণ করে। কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও ছেলেদের পক্ষে কখনও পেটে সন্তান ধারণ করা সম্ভব নয়। সুযোগ থাকলে ছেলেরা নিশ্চয়ই মেয়েদের সন্তান ধারণের কষ্টে লাঘব করবার জন্যে ভাগাভাগি করে (পাঁচমাস পাঁচ দিন করে) সন্তানকে পেটে ধারণ করতো। আমরা প্রবীণরা প্রায় সময়েই অতীত প্রিয়তার জন্য অচল জিনিসকে কথা দিয়ে সচল রাখতে চাই।’ বুদ্ধির ঢেঁকি কথাটিও সেরকম। আমি ভড়কে গিয়েছিলাম যখন একটা কম বয়সী ছেলে আমাকে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো যে ‘ঢেঁকি জিনিসটি কি। আমি অনেক কায়দা কসরৎ করেও ছেলেটিকে ঢেঁকি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দিতে পারেনি। এমন কিছু কথা রয়েছে যা আমরা নির্দ্ধিধায় উৎসাহের সাথে বলে থাকি। এর মধ্যে একটি হলো ‘ঘুষ খাওয়া’ কথাটি। সেদিন আমার এক পুরনো বন্ধু আমার বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন। অনেক কাল পরে দেখা তাই দু’জনেই মনের আনন্দে বকবক করছিলাম। আমাদের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিলো ‘ঘুষ খাওয়া’ নিয়ে। আমরা বারবার ‘ঘুষ খাওয়া’ কথাটি বলছিলাম। আমার সাড়ে তিন বছর বয়সী নাতনী মনোযোগ দিয়ে আমাদের কথা শুনছিলো। এক সময় আমার কাছে এসে সে আবদার করে বললো, ‘দাদু আমি ঘুষ খাবো’। সে চকলেটের মতো ঘুষকেও একটা খাবার মনে করেছিলো। আমার মনে হয় আমাদের এ দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা হলো ‘ঘুষ’। ঘুষ কথাটি এখনও বাতিল যোগ্য কথা হয়নি, কিন্তু এখনও আমরা অনেক বাতিলযোগ্য কথা ব্যবহার করে চলেছি। মাঝে মাঝে ভাবি নিজেও বাতিলযোগ্য মানুষ হয়ে গেলাম কিনা। লেখক: রম্যসাহিত্যিক
source:
http://www.dainikazadi.org/details2.php?news_id=2304&table=june2012&date=2012-06-21&page_id=25