ভূমিকম্প: অদৃশ্য বিভীষিকা ও আমাদের প্রস্তুতি

 


ভূমিকম্প: এক ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ

ভূমিকম্প এমন একটি দুর্যোগ, যা কোনো ধরনের পূর্বাভাস না দিয়েই মুহূর্তের মধ্যে আঘাত হানে। অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যেমন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস বা বজ্রপাতের ক্ষেত্রে সাধারণত পূর্বাভাস পাওয়া যায় এবং মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ভূমিকম্পের ক্ষেত্রে বিজ্ঞান এখনো কার্যকর কোনো পূর্বাভাস দেওয়ার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে ভবিষ্যতে ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা প্রদান করা সম্ভব হয়।

ভূমিকম্পের মাত্রা ও এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব

ভূমিকম্পের মাত্রা পরিমাপের জন্য রিখটার স্কেল ব্যবহৃত হয়, যার পরিসীমা ১ থেকে ১০ পর্যন্ত। ভূমিকম্পের মাত্রা ৫-এর ওপরে হলে সেটিকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রিখটার স্কেলে ৫ থেকে ৫.৯৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে মাঝারি, ৬ থেকে ৬.৯৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে তীব্র, ৭ থেকে ৭.৯৯ মাত্রার ভূমিকম্পকে ভয়াবহ এবং ৮-এর ওপরে হলে সেটিকে মহাদুর্যোগ হিসেবে ধরা হয়।

ভূমিকম্পের মাত্রা যত বেশি হয়, এর ধ্বংসযজ্ঞ তত ভয়াবহ হয়। ছোট ভূমিকম্পে সাধারণত বড় ধরনের ক্ষহয় না, তবে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেই ভবন ধসে পড়তে পারে, বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট বা গ্যাসলাইনের বিস্ফোরণের কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে পুরো জনপদই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। যদি ভূমিকম্প সমুদ্রের তলদেশে ঘটে, তাহলে তা ভয়ংকর সুনামির সৃষ্টি করতে পারে, যা উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটাতে সক্ষম।

বিশ্বের ভয়াবহ ভূমিকম্পের উদাহরণ

ইতিহাসে বেশ কয়েকটি ভয়াবহ ভূমিকম্পের নজির রয়েছে, যেগুলো অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়েছে এবং সম্পদহানি করেছে। যেমন:

  • ২০০৪ সালের ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্প ও সুনামি: রিখটার স্কেলে ৯.১ থেকে ৯.৩ মাত্রার এই ভূমিকম্প ২৬ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরের ৩০ কিলোমিটার গভীরে আঘাত হানে। এতে ১৪টি দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।
  • ২০১১ সালের জাপানের ভূমিকম্প: ১১ মার্চ, রিখটার স্কেলে ৮.৯ মাত্রার ভূমিকম্প কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয়েছিল, যা সুনামির সৃষ্টি করে এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি করে।
  • ১৯৬০ সালের চিলির ভূমিকম্প: ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্প এটি, যার মাত্রা ছিল ৯.৫। এতে চিলিতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ নেমে আসে। এই বিপর্যয়ের পর চিলি সরকার বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করে, যার ফলে ভবিষ্যতে বড় ভূমিকম্পেও দেশটিতে তুলনামূলক কম ক্ষতি হয়েছে।

বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকি

বাংলাদেশ একটি ভূমিকম্পপ্রবণ দেশ। ভূতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে, বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম স্থানে রয়েছে। বিশেষ করে সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিকম্পের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। ঢাকাও ভূমিকম্পের ঝুঁকির বাইরে নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ঢাকায় রিখটার স্কেলে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প ঘটে, তবে প্রায় ৭২ হাজার ভবন ধসে পড়তে পারে। আর ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হলে দেড় থেকে দুই লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কারণ, ঢাকা শহরে ঘনবসতি, অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ ও দুর্বল কাঠামোর কারণে ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মারাত্মক হতে পারে।

ভূমিকম্প প্রতিরোধে করণীয়

ভূমিকম্প প্রতিরোধ সম্ভব না হলেও সচেতনতা ও পরিকল্পিত উদ্যোগের মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এ জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া জরুরি:

  1. বিল্ডিং কোড মেনে ভবন নির্মাণ: ভূমিকম্প সহনীয় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কঠোর নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হবে।
  2. পুরনো ও দুর্বল ভবনের সংস্কার: যেসব ভবন খুব পুরনো এবং ভূমিকম্প সহনীয় নয়, সেগুলো শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে অথবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে ফেলতে হবে।
  3. সচেতনতামূলক প্রশিক্ষণ: স্কুল, কলেজ, অফিস ও বাসাবাড়িতে ভূমিকম্প মোকাবিলায় করণীয় সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
  4. জরুরি উদ্ধার পরিকল্পনা: ভূমিকম্পের সময় কীভাবে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া যায় এবং কীভাবে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করা যায়, সে সম্পর্কে প্রস্তুতি থাকা জরুরি।
  5. সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ: ভূমিকম্প মোকাবিলার জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও গবেষণা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

উপসংহার

ভূমিকম্প একটি ভয়াবহ দুর্যোগ, যা মুহূর্তের মধ্যে বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। এটি শুধু মানুষের জীবনই কেড়ে নেয় না, সভ্যতাকেও ধ্বংস করে দিতে পারে। বাংলাদেশ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, তাই এখনই যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। পরিকল্পিত নগরায়ণ, বিল্ডিং কোডের কঠোর বাস্তবায়ন ও সচেতনতার মাধ্যমে আমরা ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি অনেকাংশে কমিয়ে আনতে পারি। সতর্কতাই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় রক্ষা কবচ।