আমি গভীর মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলাম। পাশে বারান্দায় আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটা রান্নাবাটি খেলায় মগ্ন। হঠাৎ দৌড়ে এসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— বাবা, চা খাবে?
চা খাওয়ার অভ্যাসটা আমার বহুদিনের, সেটা ও ভালোই জানে। ওর খেলনার কাপটা হাতে নিয়ে অভিনয় করে চুমুক দিলাম, মুখ ভরে প্রশংসা করলাম,
— খুব ভালো হয়েছে মা!
ও খুশি হয়ে আবার প্রশ্ন করল,
— আর এক কাপ খাবে?
— না মা, আমি এখন পড়ছি।
— তাহলে হরলিক্স খাও! শক্তি হবে!
আমি বই থেকে চোখ সরিয়ে ওর দিকে তাকালাম। আমার শরীর-স্বাস্থ্যের এতটা চিন্তা বোধহয় আমার মা ছাড়া আর কেউ করেছে বলে মনে পড়ে না! একটানে ওকে কোলে টেনে নিলাম। মাথা আমার ঘাড়ে রেখে চুপচাপ শুয়ে রইল ও। ছোট্ট শরীরের উষ্ণতা, চুলের মিষ্টি গন্ধ—সব মিলিয়ে যেন এক অন্যরকম অনুভূতি! চোখটা ঝাপসা হয়ে এল। আহা মা! আহারে এই বন্ধন! মাঝে মাঝে কেন যে এভাবে চোখ ভিজে আসে! সব বাবাই কি আমার মতো লুকিয়ে কাঁদে?
আমার মনে পড়ে গেল আমার বিয়ের দিনটার কথা। বিদায়বেলায় শ্বশুরমশাই যখন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে কেঁদেছিলেন, তখন আমি নির্বাক দাঁড়িয়ে ছিলাম। হাত কাঁপতে কাঁপতে আমার হাত চেপে ধরে বলেছিলেন,
— মেয়েটা আমার খুব আদরের, ও কোনো ভুল করলে আমাকে বলবে বাবা, বকাঝকা করো না।
আমি আশ্বাস দিয়ে মাথা নেড়েছিলাম, ঠিক আছে বাবা!
কিন্তু আমি কথা রাখতে পারিনি। সংসারের ব্যস্ততায়, টানাপোড়েনে, অভিমানে আমি কখনো কখনো আরেকজনের কন্যাকে কাঁদিয়েছি, বকাঝকাও করেছি। জানি, আমার স্ত্রী সেসব মনে রাখে না। সে এখন শুধু আমাদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত। তার নিজের পৃথিবী বলতে এখন শুধু আমাদের দুই সন্তান আর আমি। ভাবতে অবাক লাগে, কেমন নিঃস্বার্থভাবে একজন নারী তার নিজের পুরো জীবনটাকে এক নতুন বৃত্তে ঢেলে দেয়!
আমার এই ছোট্ট মেয়েটাও একদিন আমাকে কাঁদিয়ে নতুন এক বৃত্তে চলে যাবে! আমাকেও হয়তো তখন আরেক যুবকের হাতে ওর হাত তুলে দিয়ে বলতে হবে,
— আমার মেয়েটা খুব আদরের, ও কোনো ভুল করলে বকাঝকা করো না।
আমি চাই না, আমার কোনো ব্যর্থতা আমার কন্যাকে স্পর্শ করুক। আমি ক্ষমাপ্রার্থী—কথা রাখতে না পারার জন্য!
কন্যার পিতা হওয়া কতটা কঠিন, সেটা না হলে অনুভব করা যায় না। আমার চোখের কোণে অশ্রু জমছে। আর আমার ছোট্ট মেয়েটা? সে যেন সব বুঝতে পারছে! ভ্রু কুঁচকে পড়ার চেষ্টা করছে, যেন কোনো অপরাধীর জবানবন্দি নিচ্ছে। ওর চোখেও জল!
কি জানি! মেয়েরা হয়তো বাবার অনুভূতি পড়তে পারে। হয়তো সৃষ্টিকর্তাই মেয়েদের এমন শক্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন—বাবার হৃদয়ের ভাষা বোঝার এক অলৌকিক ক্ষমতা!