আগে যা-ই পড়ে থাকুন, কিংবা না থাকুন না কেন, যদি এ সময়ে একেবারে জিরো
থেকে প্রিপারেশন নেয়া শুরু করেন, তাহলে কি আপনার পক্ষে প্রিলি পাস করে
রিটেনের পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব? এটা অনেকটাই নির্ভর করে তিনটি ফ্যাক্টরের
উপর।
এক। আপনার আত্মবিশ্বাস।
দুই। আপনার বেসিক নলেজ।
তিন। আপনার প্রচণ্ড পরিশ্রম করার মানসিকতা।
একটু ভেঙে বলছি।
প্রথমটি। যারা পরীক্ষায় ভাল করে, তাদের ভাল রেজাল্টের জন্য যতটা না প্রস্তুতির ভূমিকা, তার চাইতে অনেকবেশি ভূমিকা ‘আমি অবশ্যই পারবো’ এই মাইন্ড সেটআপের। যেকোনো প্রতিযোগিতায়ই বিজয়ী আর পরাজিতের মধ্যে মূল পার্থক্যটা তৈরি করে দেয় আত্মবিশ্বাস। বলতে পারেন, যারা আগে তেমনকিছু পড়েননি, তারাও কেন আত্মবিশ্বাসী থাকবেন? থাকবেন, কারণ ভাল প্রস্তুতি নিলেই যেমন প্রিলিপাস করা যায় না, ঠিক তেমনি খারাপ প্রস্তুতি নিলেই প্রিলিফেইল করা যায় না। আসলে, ভাল প্রস্তুতি খারাপ প্রস্তুতি বলে কিছু নেই। যা আছে, তা হলো, পরীক্ষা ভাল দেয়া, কিংবা খারাপ দেয়া। লোকে পারে তখনই যখন সে মন থেকে বিশ্বাস করে, সে ওই কাজটি পারে। এ বিশ্বাসের পরিমাণ যার যত বেশি, তার পারফরম্যান্স তত বেশি ভাল। জানি, এই সময়টাতে, সাফল্যের জন্য আত্মবিশ্বাস জরুরি, নাকি, আত্মবিশ্বাসী হওয়ার জন্য আগে সফল হওয়াটা জরুরি—এই ধন্দে আছেন। সবাইই থাকে। আপনি ব্যতিক্রম কিছু নন। তবে এর মধ্যেও যে নিজেকে অসীম ধৈর্যে ধরে রাখতে পারে, সে-ই ব্যতিক্রম, সে-ই নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাবে।
দ্বিতীয়টি। আপনি যে যে বিষয় ভাল পারেন আগে থেকেই, সেগুলিকে আপনি প্রিলিপাস করার মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করুন। আমি আমারটা বলি। যদি এই লেখাটি যখন লিখছি, ঠিক সে মুহূর্তেও প্রিলি পরীক্ষা দিতে বসি, প্রশ্ন যেমনই হোক না কেন, আমি পাস করবোই। আগের বাক্যে ক্রিয়া পদের সাথে ‘-ই’ প্রত্যয় যোগ করে দিয়েছি প্রত্যয়ের সাথে। কেন? কোন অসীম আত্মবিশ্বাসে? বলছি। আমি যেকোনো পরীক্ষায় বসার আগেই ঠিক করে নিই, আমার তুরুপের তাস কোনটা কোনটা। প্রিলির কথা যদি ধরি, তাহলে আমি যা যা করবো, বলছি। গাণিতিক যুক্তি যে কয়টি প্রশ্ন আসবে, তার সবকটারই সঠিক উত্তর করতে পারবো (বড়োজোর ১টা ভুল হতে পারে)। মানসিক দক্ষতায় ভুল হবে বড়োজোর ৩-৪টা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অংশে ভুল হবে হয়তো ৪-৫টা। ইংরেজিতে ৮০% নম্বর পাওয়ার কথা। বাংলায় অন্তত ৬৫%। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে ৩৫% তো রামছাগলও পাবে। গতানুগতিক ধাঁচের প্রশ্ন হলে মোটামুটি এরকমই হবে মনে হয়। প্রশ্ন কঠিন হলেও কোনো অসুবিধে নেই। সে ক্ষেত্রে তো কাটমার্কসও কমে আসবে। এইতো! প্রিলিতে পাস করে ফেলার কথা তো এভাবে পরীক্ষা দিলে, তাই না? আপনার হাতে যে কদিন আছে সামনে, সে কদিনে আপনি যে ৪টি সেগমেন্ট ভাল পারেন, সেগুলিতে বেশি এফর্ট দিন। সবসময়ই মাথায় রাখবেন, অনলি ইয়োর রেজাল্ট ইজ রিওয়ার্ডেড, নট ইয়োর এফর্টস্। তাই এফর্ট দেবেন অবশ্যই অবশ্যই রেজাল্ট-ওরিয়েন্টেড উপায়ে।
তৃতীয়টি। আপনাকে এ কদিন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হবে। যদি চাকরিটা সত্যিই আপনার প্রয়োজন হয়, তবে আপনি এ কদিন দৈনিক ১৭ ঘণ্টা করে পরিশ্রম করতে পারবেন। কলকাতার অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রশংসাসূচক যা-ই কিছু বলি না কেন, কম বলা হয়ে যাবে। উনি যদি অভিনয় শিল্প আর লেখার প্রতি প্যাশন থেকে এই ৮১ বছর বয়সে দৈনিক ৮-৯ ঘণ্টা শুটিং করার পর আবার ৪-৫ ঘণ্টা লেখালেখি করতে পারেন, তবে আপনি মাত্র ২৭-২৮ বছর বয়সে, তাও মাত্র ১০টা দিন দৈনিক গড়ে ১৭ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে পারবেন না? আমাদের প্রাক্তন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক ছিলেন। ৮৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর দিন কিংবা এর আগের দিনও (আমার ঠিক মনে নেই) তিনি ৩০ পৃষ্ঠা অনুবাদ করেছিলেন। খ্যাতনামা বাঙালি মননশীল লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ নীরদচন্দ্র চৌধুরীর শেষ বই ‘থ্রী হর্সম্যান অব দ্য নিউ এপোক্যালিপস’ যখন প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর বয়স ৯৯ বছর। জীবদ্দশায় উনি বই পড়েছিলেন প্রায় ১০ হাজার। জীবনে অতি পরিশ্রমের কারণে তাঁর যে ক্ষতিটি হয়েছিল, তা হলো, উনি উনার ১০২তম জন্মদিনের দু’মাস পূর্বে ‘অকালপ্রয়াত’ হয়েছিলেন। তিনটি উদাহরণই বরেণ্য বাঙালির। উনাদের শারীরিক গঠন আপনার আমার চাইতে অনেক মজবুত ছিল না। তবে মানসিক গঠন শতগুণে মজবুত ছিল। চাকরিটা আপনার যত বেশি দরকার, আপনি তত বেশি মানসিকভাবে তৈরি থাকবেন পরিশ্রম করতে, এটা আমি বিশ্বাস করি। মানুষ টায়ার্ড হয় যতটা না শারীরিক কারণে, তার চাইতে অনেকবেশি মানসিক কারণে। কই, পড়াশোনা করতে করতে একেবারেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমাকে কেউ যদি শপিং-এ যেতে বলে, ঘুরতে যেতে বলে, ডেটিং-এ যেতে বলে, আমার সকল ক্লান্তি তো এক নিমিষেই পালিয়ে যায়! এটা ফাজলামো ছাড়া আর কী? লাইফের সাথে আপনি যত বেশি ফাজলামো করবেন, লাইফও আপনার সাথে তত বেশি ফাজলামো করবে। মাথায় রাখুন, সামনের ১০ দিনে আপনাকে মোট ১৭০ ঘণ্টা পড়াশোনার পেছনে ফাঁকিবাজি না করে ঠিকভাবে দিতে হবে। আপনি প্রিলিপাস করে যাবেন এটা করতে পারলে, আগে যদি কিছু না পড়েও থাকেন। ব্যস্!
এখন পর্যন্ত আপনার প্রস্তুতি যেরকমই হোক না কেন, সামনের এই ১০টা দিন আপনি যা যা করতে পারেন (আমার ব্যক্তিগত অভিমত অনুসারে), এবং যা যা এড়িয়ে চলতে পারেন, লিখে দিচ্ছি:
এক। বাজারের যেকোনো একটা ভাল মডেল টেস্টের গাইড কিনে প্রতিদিন ৫ সেট করে মডেল টেস্ট দিন। প্রতি সেট প্রশ্নের উত্তর দাগাতে সময় নেবেন বড়োজোর সোয়া এক ঘণ্টা। কারণ, পরীক্ষার হলে আপনাকে বৃত্ত ভরাট করতে হবে, সেটাতে কিছু বাড়তি সময় লাগবে। তাছাড়া পরীক্ষার হলে টেনশনও কাজ করবে, যা আপনার বৃত্ত ভরাটের গতিকে কিছুটা হলেও মন্থর করে দিতে পারে। পরীক্ষার সময় টেনশনে থাকাটা একটা সাধারণ শিষ্টাচার। ব্যাপার না! এই ১০ দিন পারতপক্ষে আপনার পড়ার রুম থেকেই বের হবেন না।
দুই। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কারোর ফোনই রিসিভ করবেন না। কেউ অসুস্থ হলে, কিংবা আপনার একেবারেই কাছের কেউ অতি প্রয়োজনে ফোন করলে রিসিভ করবেন। আপনার প্রেমিকা অন্য কারোর হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে? যেতে দিন। ও পরে এমনিতেই পালাত। প্রেমিকা পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর স্বাভাবিক চিরন্তন দৃশ্যগুলির একটি। যত আগে পালায়, ততই মঙ্গল। শুকরিয়া! এ কদিন এসব নিয়ে ভাববার সময় নেই আপনার। কারোর সাথে নিতান্ত জরুরি না হলে দেখা করারও দরকার নেই। ঠিকমতো পড়াশোনা করলে এই সময়টাতে আপনার চাঁদমুখখানা প্যাঁচামুখ হয়ে যাওয়ারই কথা। তাই, মানুষের সামনে গিয়ে ভয় না দেখিয়ে দরোজাজানালা বন্ধ করে পড়াশোনা করলেই তো বেটার, তাই না? আপনার চেহারা খারাপ, তাই বলে তো আর আপনি লোকজনকে ভয় দেখাতে পারেন না! ওটা অন্যায়, চেহারা বাজে হওয়াটা অন্যায় নয়। মোবাইল ফোন, টিভি, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার, হোয়াটসআপ এসবকে দিন এই ১০ দিন ছুটি, বেকারত্বের রাজ্যে পৃথিবী যন্ত্রণাময়। নিষ্ঠুর পৃথিবী বেকারদের মিষ্টি রোমান্টিক হাসিও সহ্য করে না।
তিন। ভাল ১টা প্রিলির ডাইজেস্ট পুরোটা খুব দ্রুত পড়ে ফেলুন। বিভিন্ন প্রিলি স্পেশাল সংখ্যা সলভ করুন। আগের বছরের প্রশ্নসমৃদ্ধ প্রিলির প্রশ্নব্যাংক আর ১টা জব সল্যুশন রিভিশন দিন। বলতে পারেন, প্রশ্ন যদি গতানুগতিক ধাঁচের না হয়, তবে? আমি বলি কী, যেহেতু আগে থেকে রেফারেন্স বইটই উল্টেপাল্টে, হাজার হাজার প্রশ্ন সলভ্ করেটরে অনেকবেশি পড়াশোনা করেননি, সেহেতু ফাঁকিবাজির এইটুকু শাস্তি তো মেনে নিতেই হবে। মজার ব্যাপার হলো, মূলত নার্ভাসনেস ফ্যাক্টরের কারণে, পরীক্ষার হলে সবারই মেন্টাল স্টেট কমবেশি একইরকমের থাকে। অর্থাৎ, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে, আপনি কারোর চাইতেই পিছিয়ে নন। প্রশ্ন সহজ হবে, কী কঠিন হবে, এ নিয়ে ভাবা মানেই স্রেফ সময় নষ্ট করা। প্রশ্ন সহজ বা কঠিন হওয়ার উপর তো আপনার হাত নেই। যেটার উপর আপনার কোনো হাত নেই, সেটা নিয়ে ভেবে ভেবে সময় নষ্ট না করে পড়াশোনা করুন। কঠিন হলে সবার জন্যই কঠিন, সহজ হলে সবার জন্যই সহজ। সবার যে গতি, আপনারও একই গতি। আপনি তো আর বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন যে, আপনার জন্য আলাদা কোনো কাটমার্কস হিসেব করা হবে।
চার। বিষয় ধরে ধরে নয়, প্রশ্নের সেট ধরে ধরে পড়ুন। কীরকম? ধরুন, আপনি বাংলা পড়বেন। ঠিক আছে, পড়ুন। কিন্তু শুধু বাংলাই পড়তে থাকার মতো সময় এখন আর নেই। এতে কোনো না কোনো বিষয়ের উপর কম জোর দেয়া হয়ে যেতে পারে। আপনি এই সময়টাতে জব সল্যুশন, প্রিলি ডাইজেস্ট, আর প্রশ্ন ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ প্রশ্নের সেট ধরে ধরে যত বেশি সংখ্যক সম্ভব, তত বেশি সংখ্যক প্রশ্নের সেট পড়ে ফেলুন। আলোচনা অংশ পড়বেন না। দরকার নেই। বেশি বেশি প্রশ্নের সেট পড়ে ফেললে, আপনি দেখবেন, কিছু কিছু প্রশ্ন বারবার আসে। সেগুলি বারবার দেখতে দেখতে মাথায় সেগুলির একটা ফটোকপি তৈরি হয়ে যায় আপনাআপনিই। কোনো বিষয়ের উপর আলাদা করে সময় দেয়ার দরকার নেই। কেউ যদি ওটা করেন, তবে আপনি সুষম প্রস্তুতি নিতে পারবেন না।
পাঁচ। সাধারণ জ্ঞানে জোর দিন সবচাইতে কম। যদি কমন প্রশ্ন আসে, এমনিতেই পারবেন। যদি একেবারে উদ্ভট আনকমন প্রশ্ন আসে, যতই প্রস্তুতি নিন না কেন, পারবেন না। অথচ, ম্যাথস্, গ্রামার সহ আরও কিছু টপিক আছে, যেগুলিতে বেসিক ভাল হলে, প্রশ্ন কঠিন হলেও সঠিক উত্তর করা সম্ভব। এই ১০ দিনে পেপার পড়ার আর খবর শোনার কোনো দরকার নাই। পৃথিবীতে প্রলয় ঘটে গেলে কোনো না কোনোভাবে এমনিতেই জানতে পারবেন। ঐশ্বরিয়া কেন এ বয়সেও আবেদনময়ী, সে প্রশ্নের রগরগে উত্তর জেনে জ্বালা বাড়ানোর সময় প্রিলিটা শেষ হয়ে গেলে যথেষ্টই পাবেন। আপাতত অফ যান!
ছয়। ৬.১। যে প্রশ্নগুলি বেশিই কঠিন, বারবার পড়লেও মনে থাকে না, সেগুলিকে নিজগুণে ক্ষমা করে দিন। সহজ প্রশ্ন মাথায় সুন্দর, কঠিন প্রশ্ন বইয়ে। একটা অতি কঠিন প্রশ্ন মনে রাখার চেষ্টা ৫টা সহজ প্রশ্নকে মাথা থেকে বের করে দেয়। মার্কস তো একই, কী দরকার? ১ নম্বরের মোহে ৫ কিংবা ৭.৫ নম্বর হারানোর বিলাসিতা করার সময় এখন নয়।
৬.২। কনফিউজিং প্রশ্ন দাগাবেন কিনা? এর উত্তরটা একটু ঘুরিয়ে দিই। ৮টা কনফিউজিং প্রশ্ন ছেড়ে এসে শূন্য পাওয়ার চাইতে ৮টাই দাগিয়ে অর্ধেক ভুল করে ২ পাওয়া তো ভাল, তাই না? কনফিউজিং প্রশ্ন দেয়াই হয় আপনার বৃত্ত ভরাট করার গতিকে শ্লথ করে দেয়ার জন্য।
৬.৩। যে প্রশ্নগুলি ভুল থাকে, সেগুলি দাগালেও নম্বর পাবেন, না দাগালেও নম্বর পাবেন। পিএসসি সেগুলি বাদ দিয়ে খাতা দেখে, মানে সেগুলিতে সবাইকেই অ্যাভারেজ নম্বর দিয়ে দেয় বলেই জানি।
৬.৪। কিছু প্রশ্নের একাধিক উত্তর থাকে। সেগুলিতে কী করবেন? যেকোনো একটা সঠিক উত্তর দাগালেই নম্বর পাবেন। ভুল উত্তর কিংবা একাধিক উত্তর আছে, এমন প্রশ্ন পিএসসি কেন দেয়? ওরা অসতর্ক দায়িত্বজ্ঞানহীন উদাসীন বলে? কোনোভাবেই না! এগুলি দেয়াই হয় ইচ্ছে করে, আপনাকে কনফিউসড আর নার্ভাস করে দেয়ার জন্য। আপনি কনফিউসড আর নার্ভাস হয়ে যাওয়ার মানেই হলো, আপনার কনফিডেন্স কমে যাওয়া। আর এর মানেই হলো, ওই ২ ঘণ্টা আপনার নয়! প্র্যাকটিস তো সবাইই করে, কিন্তু ফিল্ডে থাকার সময়টা অন্য কারোর হয় না, টেন্ডুলকারের হয়। কেন? প্রিপারেশনের জন্য? স্কিলের জন্য? না। কনফিডেন্স আর টেকনিকের জন্য। ফিল্ডে সেই রাজা, যে রাজার মতো খেলতে পারে। ওরকম করে খেলতে হলে রাজার হৃদয়ের দরকার হয়।
সাত। কে কী পড়ছে, কী কী প্রশ্ন পড়া উচিত, এসব ফালতু খবর নেয়ার দরকার নাই। আপনি এই ১০দিনে বিসিএস নিয়ে কারোর সাথেই একটি কথাও বলবেন না। কে কী করছে, তাতে আপনার কী? দিনশেষে আপনার সকল সফলতা আর ব্যর্থতার দায়ভার সম্পূর্ণই আপনার নিজের। লাইফটা ডেসটিনি কোম্পানি না, লাইফ ‘টুগেদার উই বিল্ড আওয়ার ড্রিম’ নীতিতে চলে না। সাকসেস ইজ অ্যা সেলফিশ গেইম, সো ইজ ফেইলিয়্যুর। আপনি যা পারেন, আপনার ভালোর জন্যই পারেন; যা পারেন না, আপনার ভালোর জন্যই পারেন না। আপনার একটা ৫ দরকার; সেটা আড়াইয়ে আড়াইয়ে হোক, দুইয়ে তিনে হোক, তিনে দুইয়ে হোক, একে চারে হোক, চারে একে হোক, শূন্যে পাঁচে হোক, আর পাঁচে শূন্যতেই হোক, যেভাবেই হোক না কেন, হলেই তো হলো। কীভাবে হলো, সেটার রহস্য আপনার না জানলেও চলবে। বিশ্বাস রাখুন, আপনার প্রয়োজনীয় সংখ্যাটি আপনি পাবেনই। সেটার জন্য কারোর মুখাপেক্ষী আপনাকে হতে হবে না।
আট। বেশিরভাগ সময়ই, কোচিং সেন্টার, ক্যাম্পাস-লাইব্রেরি আর মুখেমুখে হিরো, পরীক্ষার হলে জিরো। যুদ্ধের আগে হিরো হয়ে কী লাভ? যুদ্ধে আর যুদ্ধের পর যেন হিরো হতে পারেন, সে প্রস্তুতি নিন। যারা পরীক্ষার আগেই বেশি পকপক করে, তারা পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর পালিয়ে মুখ লুকানোরও জায়গা খুঁজে পায় না। রেজাল্ট সবসময়ই খেলার শেষে, আগে নয়!
নয়। ২৯ তারিখ রাত ৮টার পর থেকে আর না পড়লেই ভাল। সেসময় হাল্কা কিছুতে, যা আপনার ভাল লাগে, ডুব দিন। সফট ইন্সট্রুমেন্টাল, মুভি, মিউজিক, যা-ই হোক। পরেরদিনের জন্য পরীক্ষার হলের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুন। রাতে হাল্কা খাবার খেয়ে ১০টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ুন। অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমাবেন। রাতে কম ঘুমালে পরেরদিন পরীক্ষা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুব খুব বেশি।
দশ। পরদিন সকালে উঠে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করুন। এরপর ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে (বেশি খাবেন না, এতে উচ্চশিক্ষার্থে কিংবা হুদাই কোনো কারণ ছাড়া বাথরুমে যেতে ইচ্ছে করতে পারে। পরীক্ষার চলাকালীন বাথরুমে যায় দুই ধরনের মানুষ। এক। বেকুবরা, টয়লেটের এবং এর আশেপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করতে। দুই। অসহায়রা, যাদের আসলেই বাথরুম পেয়েছে।) হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে (কোনো বইপত্র নিয়ে নয়) হলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আরও একবার দেখে নিন, প্রয়োজনীয় সবকিছু সাথে নিয়েছেন কিনা।
এগারো। উত্তরপত্রে সেট কোড সহ অন্যান্য তথ্য ঠিকভাবে ঠাণ্ডামাথায় পূরণ করুন। এটা ভুল হলে সব শেষ।
বারো। আপনি যে অংশটি সবচাইতে ভাল পারেন, সেটি আগে উত্তর করা শুরু করবেন। তবে এক্ষেত্রে কত নম্বর প্রশ্নের উত্তর করছেন আর কত নম্বর উত্তরের বৃত্তটি ভরাট করছেন, সেটি খুব সতর্কভাবে মিলিয়ে নেবেন। সব প্রশ্নই উত্তর করার জন্য নয়। লোভে পাপ, পাপে নেগেটিভ মার্কস। সাধারণত যেকোনো বিষয় নিয়ে ২য় ভাববার সময় আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। প্রথম দেখায় যে প্রশ্নগুলির উত্তর পারেন না মনে হবে, সেগুলি মার্ক করে পরেরটায় চলে যাবেন। পরীক্ষার হল গবেষণাগার নয়। সময় নষ্ট করার সময় নেই।
তেরো। বৃত্ত ভরাট করতে করতে ক্লান্ত? একটু ব্রেক নিন। চাকরিটা পেয়ে গেলে আপনার জীবনটা কীভাবে বদলে যাবে, কাছের মানুষগুলির হাসিখুশি মুখগুলি একবার কল্পনায় আনুন; ক্লান্তি কেটে যাবে। পরীক্ষার হলে যে ভাবনাটা সবচাইতে বেশি ম্যাজিকের মতো কাজ করে, সেটি হল ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট’ ভাবনা। আপনার চাইতে ভাল পরীক্ষা কেউই দিচ্ছে না, এটা বিশ্বাস করে পরীক্ষা দিন। অন্যকিছু মাথায় আনলে আপনার ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছুই হবে না।
চৌদ্দ। কয়টা দাগালে পাস, এমন কোন নিয়ম নেই। আপনি যেগুলি পারেন, সেগুলির উত্তর করবেন। কোন প্রশ্নেই বেশি গুরুত্ব দেবেন না। সহজ কঠিন সব প্রশ্নেই ১ নম্বর। আপনার আশেপাশে কে কয়টা দাগাচ্ছে, কোনটা দাগাচ্ছে, সেদিকে তাকাবেন না। এতে আপনি ১ নম্বরের লোভে বেশ কিছু জানা প্রশ্ন ভুল দাগাতে পারেন। কারোর দিকেই না তাকিয়ে আপনি নিজে যা পারেন, তা-ই উত্তর করুন। অবশ্য, আপনি না তাকালেও আপনার অজানা কিছু প্রশ্নের উত্তর গায়েবি হাওয়ায় ভেসে ভেসে প্রবেশ করবে কানের গহীনে। সেগুলিকে গ্রহণ করবেন, কী বর্জন করবেন, সে সিদ্ধান্ত ওই মুহূর্তের আইকিউই বলে দেবে।
সামনের ১০ দিনে আপনার জীবনের অন্তত ৩০ বছরের ইতিহাস লেখা হয়ে যেতে পারে। সে ইতিহাস আনন্দের, নাকি বেদনার, সেটা নির্ধারণ করার ৯৫% ক্ষমতাই এই মুহূর্তে আপনার হাতে। আপনি সেটাকে কীভাবে কাজে লাগাবেন, কিংবা কাজে লাগাবেন না, সেটা পুরোপুরিই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি শুধু আমার নিজের মতামত বললাম এতক্ষণ। জীবনটা আপনার, সে জীবনটা কাটানোর কায়দাও আপনিই ঠিক করবেন। যত বড় বিসিএস পণ্ডিতই হোক না কেন, পরীক্ষার হলে পরিবেশ, মানসিক অবস্থা, এবং আরও কিছু পারিপার্শ্বিক কারণে উনার এবং অন্য সবার লেভেলই মোটামুটি একই জায়গায় থাকে। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা বাজবে, আপনিও জিরো থেকে শুরু করবেন, বাকিরাও জিরো থেকে শুরু করবেন। কেউই কারোর চাইতে কোনো অংশে কম না! সেই জিরোকে ২ ঘণ্টায় কে কতদূর নিয়ে যেতে পারে, তা দিয়েই ঠিক হয়ে যাবে, কে জিতবে, কে ছিটকে পড়বে!
যুদ্ধে নামুন, দেখা হবে! অপেক্ষায় রইলাম।
সুশান্ত পাল
আপনাদের সিনিয়র সহকর্মী
এক। আপনার আত্মবিশ্বাস।
দুই। আপনার বেসিক নলেজ।
তিন। আপনার প্রচণ্ড পরিশ্রম করার মানসিকতা।
একটু ভেঙে বলছি।
প্রথমটি। যারা পরীক্ষায় ভাল করে, তাদের ভাল রেজাল্টের জন্য যতটা না প্রস্তুতির ভূমিকা, তার চাইতে অনেকবেশি ভূমিকা ‘আমি অবশ্যই পারবো’ এই মাইন্ড সেটআপের। যেকোনো প্রতিযোগিতায়ই বিজয়ী আর পরাজিতের মধ্যে মূল পার্থক্যটা তৈরি করে দেয় আত্মবিশ্বাস। বলতে পারেন, যারা আগে তেমনকিছু পড়েননি, তারাও কেন আত্মবিশ্বাসী থাকবেন? থাকবেন, কারণ ভাল প্রস্তুতি নিলেই যেমন প্রিলিপাস করা যায় না, ঠিক তেমনি খারাপ প্রস্তুতি নিলেই প্রিলিফেইল করা যায় না। আসলে, ভাল প্রস্তুতি খারাপ প্রস্তুতি বলে কিছু নেই। যা আছে, তা হলো, পরীক্ষা ভাল দেয়া, কিংবা খারাপ দেয়া। লোকে পারে তখনই যখন সে মন থেকে বিশ্বাস করে, সে ওই কাজটি পারে। এ বিশ্বাসের পরিমাণ যার যত বেশি, তার পারফরম্যান্স তত বেশি ভাল। জানি, এই সময়টাতে, সাফল্যের জন্য আত্মবিশ্বাস জরুরি, নাকি, আত্মবিশ্বাসী হওয়ার জন্য আগে সফল হওয়াটা জরুরি—এই ধন্দে আছেন। সবাইই থাকে। আপনি ব্যতিক্রম কিছু নন। তবে এর মধ্যেও যে নিজেকে অসীম ধৈর্যে ধরে রাখতে পারে, সে-ই ব্যতিক্রম, সে-ই নিশ্চিতভাবে এগিয়ে যাবে।
দ্বিতীয়টি। আপনি যে যে বিষয় ভাল পারেন আগে থেকেই, সেগুলিকে আপনি প্রিলিপাস করার মূল অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করুন। আমি আমারটা বলি। যদি এই লেখাটি যখন লিখছি, ঠিক সে মুহূর্তেও প্রিলি পরীক্ষা দিতে বসি, প্রশ্ন যেমনই হোক না কেন, আমি পাস করবোই। আগের বাক্যে ক্রিয়া পদের সাথে ‘-ই’ প্রত্যয় যোগ করে দিয়েছি প্রত্যয়ের সাথে। কেন? কোন অসীম আত্মবিশ্বাসে? বলছি। আমি যেকোনো পরীক্ষায় বসার আগেই ঠিক করে নিই, আমার তুরুপের তাস কোনটা কোনটা। প্রিলির কথা যদি ধরি, তাহলে আমি যা যা করবো, বলছি। গাণিতিক যুক্তি যে কয়টি প্রশ্ন আসবে, তার সবকটারই সঠিক উত্তর করতে পারবো (বড়োজোর ১টা ভুল হতে পারে)। মানসিক দক্ষতায় ভুল হবে বড়োজোর ৩-৪টা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি অংশে ভুল হবে হয়তো ৪-৫টা। ইংরেজিতে ৮০% নম্বর পাওয়ার কথা। বাংলায় অন্তত ৬৫%। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে ৩৫% তো রামছাগলও পাবে। গতানুগতিক ধাঁচের প্রশ্ন হলে মোটামুটি এরকমই হবে মনে হয়। প্রশ্ন কঠিন হলেও কোনো অসুবিধে নেই। সে ক্ষেত্রে তো কাটমার্কসও কমে আসবে। এইতো! প্রিলিতে পাস করে ফেলার কথা তো এভাবে পরীক্ষা দিলে, তাই না? আপনার হাতে যে কদিন আছে সামনে, সে কদিনে আপনি যে ৪টি সেগমেন্ট ভাল পারেন, সেগুলিতে বেশি এফর্ট দিন। সবসময়ই মাথায় রাখবেন, অনলি ইয়োর রেজাল্ট ইজ রিওয়ার্ডেড, নট ইয়োর এফর্টস্। তাই এফর্ট দেবেন অবশ্যই অবশ্যই রেজাল্ট-ওরিয়েন্টেড উপায়ে।
তৃতীয়টি। আপনাকে এ কদিন অমানুষিক পরিশ্রম করতে হবে। যদি চাকরিটা সত্যিই আপনার প্রয়োজন হয়, তবে আপনি এ কদিন দৈনিক ১৭ ঘণ্টা করে পরিশ্রম করতে পারবেন। কলকাতার অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে প্রশংসাসূচক যা-ই কিছু বলি না কেন, কম বলা হয়ে যাবে। উনি যদি অভিনয় শিল্প আর লেখার প্রতি প্যাশন থেকে এই ৮১ বছর বয়সে দৈনিক ৮-৯ ঘণ্টা শুটিং করার পর আবার ৪-৫ ঘণ্টা লেখালেখি করতে পারেন, তবে আপনি মাত্র ২৭-২৮ বছর বয়সে, তাও মাত্র ১০টা দিন দৈনিক গড়ে ১৭ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে পারবেন না? আমাদের প্রাক্তন জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী একজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক ছিলেন। ৮৮ বছর বয়সে তিনি মারা যান। মৃত্যুর দিন কিংবা এর আগের দিনও (আমার ঠিক মনে নেই) তিনি ৩০ পৃষ্ঠা অনুবাদ করেছিলেন। খ্যাতনামা বাঙালি মননশীল লেখক ও বিশিষ্ট চিন্তাবিদ নীরদচন্দ্র চৌধুরীর শেষ বই ‘থ্রী হর্সম্যান অব দ্য নিউ এপোক্যালিপস’ যখন প্রকাশিত হয়, তখন তাঁর বয়স ৯৯ বছর। জীবদ্দশায় উনি বই পড়েছিলেন প্রায় ১০ হাজার। জীবনে অতি পরিশ্রমের কারণে তাঁর যে ক্ষতিটি হয়েছিল, তা হলো, উনি উনার ১০২তম জন্মদিনের দু’মাস পূর্বে ‘অকালপ্রয়াত’ হয়েছিলেন। তিনটি উদাহরণই বরেণ্য বাঙালির। উনাদের শারীরিক গঠন আপনার আমার চাইতে অনেক মজবুত ছিল না। তবে মানসিক গঠন শতগুণে মজবুত ছিল। চাকরিটা আপনার যত বেশি দরকার, আপনি তত বেশি মানসিকভাবে তৈরি থাকবেন পরিশ্রম করতে, এটা আমি বিশ্বাস করি। মানুষ টায়ার্ড হয় যতটা না শারীরিক কারণে, তার চাইতে অনেকবেশি মানসিক কারণে। কই, পড়াশোনা করতে করতে একেবারেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত আমাকে কেউ যদি শপিং-এ যেতে বলে, ঘুরতে যেতে বলে, ডেটিং-এ যেতে বলে, আমার সকল ক্লান্তি তো এক নিমিষেই পালিয়ে যায়! এটা ফাজলামো ছাড়া আর কী? লাইফের সাথে আপনি যত বেশি ফাজলামো করবেন, লাইফও আপনার সাথে তত বেশি ফাজলামো করবে। মাথায় রাখুন, সামনের ১০ দিনে আপনাকে মোট ১৭০ ঘণ্টা পড়াশোনার পেছনে ফাঁকিবাজি না করে ঠিকভাবে দিতে হবে। আপনি প্রিলিপাস করে যাবেন এটা করতে পারলে, আগে যদি কিছু না পড়েও থাকেন। ব্যস্!
এখন পর্যন্ত আপনার প্রস্তুতি যেরকমই হোক না কেন, সামনের এই ১০টা দিন আপনি যা যা করতে পারেন (আমার ব্যক্তিগত অভিমত অনুসারে), এবং যা যা এড়িয়ে চলতে পারেন, লিখে দিচ্ছি:
এক। বাজারের যেকোনো একটা ভাল মডেল টেস্টের গাইড কিনে প্রতিদিন ৫ সেট করে মডেল টেস্ট দিন। প্রতি সেট প্রশ্নের উত্তর দাগাতে সময় নেবেন বড়োজোর সোয়া এক ঘণ্টা। কারণ, পরীক্ষার হলে আপনাকে বৃত্ত ভরাট করতে হবে, সেটাতে কিছু বাড়তি সময় লাগবে। তাছাড়া পরীক্ষার হলে টেনশনও কাজ করবে, যা আপনার বৃত্ত ভরাটের গতিকে কিছুটা হলেও মন্থর করে দিতে পারে। পরীক্ষার সময় টেনশনে থাকাটা একটা সাধারণ শিষ্টাচার। ব্যাপার না! এই ১০ দিন পারতপক্ষে আপনার পড়ার রুম থেকেই বের হবেন না।
দুই। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে কারোর ফোনই রিসিভ করবেন না। কেউ অসুস্থ হলে, কিংবা আপনার একেবারেই কাছের কেউ অতি প্রয়োজনে ফোন করলে রিসিভ করবেন। আপনার প্রেমিকা অন্য কারোর হাত ধরে পালিয়ে যাচ্ছে? যেতে দিন। ও পরে এমনিতেই পালাত। প্রেমিকা পালিয়ে যাওয়ার দৃশ্য পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর স্বাভাবিক চিরন্তন দৃশ্যগুলির একটি। যত আগে পালায়, ততই মঙ্গল। শুকরিয়া! এ কদিন এসব নিয়ে ভাববার সময় নেই আপনার। কারোর সাথে নিতান্ত জরুরি না হলে দেখা করারও দরকার নেই। ঠিকমতো পড়াশোনা করলে এই সময়টাতে আপনার চাঁদমুখখানা প্যাঁচামুখ হয়ে যাওয়ারই কথা। তাই, মানুষের সামনে গিয়ে ভয় না দেখিয়ে দরোজাজানালা বন্ধ করে পড়াশোনা করলেই তো বেটার, তাই না? আপনার চেহারা খারাপ, তাই বলে তো আর আপনি লোকজনকে ভয় দেখাতে পারেন না! ওটা অন্যায়, চেহারা বাজে হওয়াটা অন্যায় নয়। মোবাইল ফোন, টিভি, ফেসবুক, ইমো, ভাইবার, হোয়াটসআপ এসবকে দিন এই ১০ দিন ছুটি, বেকারত্বের রাজ্যে পৃথিবী যন্ত্রণাময়। নিষ্ঠুর পৃথিবী বেকারদের মিষ্টি রোমান্টিক হাসিও সহ্য করে না।
তিন। ভাল ১টা প্রিলির ডাইজেস্ট পুরোটা খুব দ্রুত পড়ে ফেলুন। বিভিন্ন প্রিলি স্পেশাল সংখ্যা সলভ করুন। আগের বছরের প্রশ্নসমৃদ্ধ প্রিলির প্রশ্নব্যাংক আর ১টা জব সল্যুশন রিভিশন দিন। বলতে পারেন, প্রশ্ন যদি গতানুগতিক ধাঁচের না হয়, তবে? আমি বলি কী, যেহেতু আগে থেকে রেফারেন্স বইটই উল্টেপাল্টে, হাজার হাজার প্রশ্ন সলভ্ করেটরে অনেকবেশি পড়াশোনা করেননি, সেহেতু ফাঁকিবাজির এইটুকু শাস্তি তো মেনে নিতেই হবে। মজার ব্যাপার হলো, মূলত নার্ভাসনেস ফ্যাক্টরের কারণে, পরীক্ষার হলে সবারই মেন্টাল স্টেট কমবেশি একইরকমের থাকে। অর্থাৎ, মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে, আপনি কারোর চাইতেই পিছিয়ে নন। প্রশ্ন সহজ হবে, কী কঠিন হবে, এ নিয়ে ভাবা মানেই স্রেফ সময় নষ্ট করা। প্রশ্ন সহজ বা কঠিন হওয়ার উপর তো আপনার হাত নেই। যেটার উপর আপনার কোনো হাত নেই, সেটা নিয়ে ভেবে ভেবে সময় নষ্ট না করে পড়াশোনা করুন। কঠিন হলে সবার জন্যই কঠিন, সহজ হলে সবার জন্যই সহজ। সবার যে গতি, আপনারও একই গতি। আপনি তো আর বিশেষ কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন যে, আপনার জন্য আলাদা কোনো কাটমার্কস হিসেব করা হবে।
চার। বিষয় ধরে ধরে নয়, প্রশ্নের সেট ধরে ধরে পড়ুন। কীরকম? ধরুন, আপনি বাংলা পড়বেন। ঠিক আছে, পড়ুন। কিন্তু শুধু বাংলাই পড়তে থাকার মতো সময় এখন আর নেই। এতে কোনো না কোনো বিষয়ের উপর কম জোর দেয়া হয়ে যেতে পারে। আপনি এই সময়টাতে জব সল্যুশন, প্রিলি ডাইজেস্ট, আর প্রশ্ন ব্যাংকের পূর্ণাঙ্গ প্রশ্নের সেট ধরে ধরে যত বেশি সংখ্যক সম্ভব, তত বেশি সংখ্যক প্রশ্নের সেট পড়ে ফেলুন। আলোচনা অংশ পড়বেন না। দরকার নেই। বেশি বেশি প্রশ্নের সেট পড়ে ফেললে, আপনি দেখবেন, কিছু কিছু প্রশ্ন বারবার আসে। সেগুলি বারবার দেখতে দেখতে মাথায় সেগুলির একটা ফটোকপি তৈরি হয়ে যায় আপনাআপনিই। কোনো বিষয়ের উপর আলাদা করে সময় দেয়ার দরকার নেই। কেউ যদি ওটা করেন, তবে আপনি সুষম প্রস্তুতি নিতে পারবেন না।
পাঁচ। সাধারণ জ্ঞানে জোর দিন সবচাইতে কম। যদি কমন প্রশ্ন আসে, এমনিতেই পারবেন। যদি একেবারে উদ্ভট আনকমন প্রশ্ন আসে, যতই প্রস্তুতি নিন না কেন, পারবেন না। অথচ, ম্যাথস্, গ্রামার সহ আরও কিছু টপিক আছে, যেগুলিতে বেসিক ভাল হলে, প্রশ্ন কঠিন হলেও সঠিক উত্তর করা সম্ভব। এই ১০ দিনে পেপার পড়ার আর খবর শোনার কোনো দরকার নাই। পৃথিবীতে প্রলয় ঘটে গেলে কোনো না কোনোভাবে এমনিতেই জানতে পারবেন। ঐশ্বরিয়া কেন এ বয়সেও আবেদনময়ী, সে প্রশ্নের রগরগে উত্তর জেনে জ্বালা বাড়ানোর সময় প্রিলিটা শেষ হয়ে গেলে যথেষ্টই পাবেন। আপাতত অফ যান!
ছয়। ৬.১। যে প্রশ্নগুলি বেশিই কঠিন, বারবার পড়লেও মনে থাকে না, সেগুলিকে নিজগুণে ক্ষমা করে দিন। সহজ প্রশ্ন মাথায় সুন্দর, কঠিন প্রশ্ন বইয়ে। একটা অতি কঠিন প্রশ্ন মনে রাখার চেষ্টা ৫টা সহজ প্রশ্নকে মাথা থেকে বের করে দেয়। মার্কস তো একই, কী দরকার? ১ নম্বরের মোহে ৫ কিংবা ৭.৫ নম্বর হারানোর বিলাসিতা করার সময় এখন নয়।
৬.২। কনফিউজিং প্রশ্ন দাগাবেন কিনা? এর উত্তরটা একটু ঘুরিয়ে দিই। ৮টা কনফিউজিং প্রশ্ন ছেড়ে এসে শূন্য পাওয়ার চাইতে ৮টাই দাগিয়ে অর্ধেক ভুল করে ২ পাওয়া তো ভাল, তাই না? কনফিউজিং প্রশ্ন দেয়াই হয় আপনার বৃত্ত ভরাট করার গতিকে শ্লথ করে দেয়ার জন্য।
৬.৩। যে প্রশ্নগুলি ভুল থাকে, সেগুলি দাগালেও নম্বর পাবেন, না দাগালেও নম্বর পাবেন। পিএসসি সেগুলি বাদ দিয়ে খাতা দেখে, মানে সেগুলিতে সবাইকেই অ্যাভারেজ নম্বর দিয়ে দেয় বলেই জানি।
৬.৪। কিছু প্রশ্নের একাধিক উত্তর থাকে। সেগুলিতে কী করবেন? যেকোনো একটা সঠিক উত্তর দাগালেই নম্বর পাবেন। ভুল উত্তর কিংবা একাধিক উত্তর আছে, এমন প্রশ্ন পিএসসি কেন দেয়? ওরা অসতর্ক দায়িত্বজ্ঞানহীন উদাসীন বলে? কোনোভাবেই না! এগুলি দেয়াই হয় ইচ্ছে করে, আপনাকে কনফিউসড আর নার্ভাস করে দেয়ার জন্য। আপনি কনফিউসড আর নার্ভাস হয়ে যাওয়ার মানেই হলো, আপনার কনফিডেন্স কমে যাওয়া। আর এর মানেই হলো, ওই ২ ঘণ্টা আপনার নয়! প্র্যাকটিস তো সবাইই করে, কিন্তু ফিল্ডে থাকার সময়টা অন্য কারোর হয় না, টেন্ডুলকারের হয়। কেন? প্রিপারেশনের জন্য? স্কিলের জন্য? না। কনফিডেন্স আর টেকনিকের জন্য। ফিল্ডে সেই রাজা, যে রাজার মতো খেলতে পারে। ওরকম করে খেলতে হলে রাজার হৃদয়ের দরকার হয়।
সাত। কে কী পড়ছে, কী কী প্রশ্ন পড়া উচিত, এসব ফালতু খবর নেয়ার দরকার নাই। আপনি এই ১০দিনে বিসিএস নিয়ে কারোর সাথেই একটি কথাও বলবেন না। কে কী করছে, তাতে আপনার কী? দিনশেষে আপনার সকল সফলতা আর ব্যর্থতার দায়ভার সম্পূর্ণই আপনার নিজের। লাইফটা ডেসটিনি কোম্পানি না, লাইফ ‘টুগেদার উই বিল্ড আওয়ার ড্রিম’ নীতিতে চলে না। সাকসেস ইজ অ্যা সেলফিশ গেইম, সো ইজ ফেইলিয়্যুর। আপনি যা পারেন, আপনার ভালোর জন্যই পারেন; যা পারেন না, আপনার ভালোর জন্যই পারেন না। আপনার একটা ৫ দরকার; সেটা আড়াইয়ে আড়াইয়ে হোক, দুইয়ে তিনে হোক, তিনে দুইয়ে হোক, একে চারে হোক, চারে একে হোক, শূন্যে পাঁচে হোক, আর পাঁচে শূন্যতেই হোক, যেভাবেই হোক না কেন, হলেই তো হলো। কীভাবে হলো, সেটার রহস্য আপনার না জানলেও চলবে। বিশ্বাস রাখুন, আপনার প্রয়োজনীয় সংখ্যাটি আপনি পাবেনই। সেটার জন্য কারোর মুখাপেক্ষী আপনাকে হতে হবে না।
আট। বেশিরভাগ সময়ই, কোচিং সেন্টার, ক্যাম্পাস-লাইব্রেরি আর মুখেমুখে হিরো, পরীক্ষার হলে জিরো। যুদ্ধের আগে হিরো হয়ে কী লাভ? যুদ্ধে আর যুদ্ধের পর যেন হিরো হতে পারেন, সে প্রস্তুতি নিন। যারা পরীক্ষার আগেই বেশি পকপক করে, তারা পরীক্ষার রেজাল্ট বের হওয়ার পর পালিয়ে মুখ লুকানোরও জায়গা খুঁজে পায় না। রেজাল্ট সবসময়ই খেলার শেষে, আগে নয়!
নয়। ২৯ তারিখ রাত ৮টার পর থেকে আর না পড়লেই ভাল। সেসময় হাল্কা কিছুতে, যা আপনার ভাল লাগে, ডুব দিন। সফট ইন্সট্রুমেন্টাল, মুভি, মিউজিক, যা-ই হোক। পরেরদিনের জন্য পরীক্ষার হলের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখুন। রাতে হাল্কা খাবার খেয়ে ১০টার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ুন। অন্তত ৮ ঘণ্টা ঘুমাবেন। রাতে কম ঘুমালে পরেরদিন পরীক্ষা খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা খুব খুব বেশি।
দশ। পরদিন সকালে উঠে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করুন। এরপর ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে (বেশি খাবেন না, এতে উচ্চশিক্ষার্থে কিংবা হুদাই কোনো কারণ ছাড়া বাথরুমে যেতে ইচ্ছে করতে পারে। পরীক্ষার চলাকালীন বাথরুমে যায় দুই ধরনের মানুষ। এক। বেকুবরা, টয়লেটের এবং এর আশেপাশের নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করতে। দুই। অসহায়রা, যাদের আসলেই বাথরুম পেয়েছে।) হাতে যথেষ্ট সময় নিয়ে (কোনো বইপত্র নিয়ে নয়) হলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান। বাসা থেকে বের হওয়ার আগে আরও একবার দেখে নিন, প্রয়োজনীয় সবকিছু সাথে নিয়েছেন কিনা।
এগারো। উত্তরপত্রে সেট কোড সহ অন্যান্য তথ্য ঠিকভাবে ঠাণ্ডামাথায় পূরণ করুন। এটা ভুল হলে সব শেষ।
বারো। আপনি যে অংশটি সবচাইতে ভাল পারেন, সেটি আগে উত্তর করা শুরু করবেন। তবে এক্ষেত্রে কত নম্বর প্রশ্নের উত্তর করছেন আর কত নম্বর উত্তরের বৃত্তটি ভরাট করছেন, সেটি খুব সতর্কভাবে মিলিয়ে নেবেন। সব প্রশ্নই উত্তর করার জন্য নয়। লোভে পাপ, পাপে নেগেটিভ মার্কস। সাধারণত যেকোনো বিষয় নিয়ে ২য় ভাববার সময় আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। প্রথম দেখায় যে প্রশ্নগুলির উত্তর পারেন না মনে হবে, সেগুলি মার্ক করে পরেরটায় চলে যাবেন। পরীক্ষার হল গবেষণাগার নয়। সময় নষ্ট করার সময় নেই।
তেরো। বৃত্ত ভরাট করতে করতে ক্লান্ত? একটু ব্রেক নিন। চাকরিটা পেয়ে গেলে আপনার জীবনটা কীভাবে বদলে যাবে, কাছের মানুষগুলির হাসিখুশি মুখগুলি একবার কল্পনায় আনুন; ক্লান্তি কেটে যাবে। পরীক্ষার হলে যে ভাবনাটা সবচাইতে বেশি ম্যাজিকের মতো কাজ করে, সেটি হল ‘আই অ্যাম দ্য বেস্ট’ ভাবনা। আপনার চাইতে ভাল পরীক্ষা কেউই দিচ্ছে না, এটা বিশ্বাস করে পরীক্ষা দিন। অন্যকিছু মাথায় আনলে আপনার ক্ষতি ছাড়া লাভ কিছুই হবে না।
চৌদ্দ। কয়টা দাগালে পাস, এমন কোন নিয়ম নেই। আপনি যেগুলি পারেন, সেগুলির উত্তর করবেন। কোন প্রশ্নেই বেশি গুরুত্ব দেবেন না। সহজ কঠিন সব প্রশ্নেই ১ নম্বর। আপনার আশেপাশে কে কয়টা দাগাচ্ছে, কোনটা দাগাচ্ছে, সেদিকে তাকাবেন না। এতে আপনি ১ নম্বরের লোভে বেশ কিছু জানা প্রশ্ন ভুল দাগাতে পারেন। কারোর দিকেই না তাকিয়ে আপনি নিজে যা পারেন, তা-ই উত্তর করুন। অবশ্য, আপনি না তাকালেও আপনার অজানা কিছু প্রশ্নের উত্তর গায়েবি হাওয়ায় ভেসে ভেসে প্রবেশ করবে কানের গহীনে। সেগুলিকে গ্রহণ করবেন, কী বর্জন করবেন, সে সিদ্ধান্ত ওই মুহূর্তের আইকিউই বলে দেবে।
সামনের ১০ দিনে আপনার জীবনের অন্তত ৩০ বছরের ইতিহাস লেখা হয়ে যেতে পারে। সে ইতিহাস আনন্দের, নাকি বেদনার, সেটা নির্ধারণ করার ৯৫% ক্ষমতাই এই মুহূর্তে আপনার হাতে। আপনি সেটাকে কীভাবে কাজে লাগাবেন, কিংবা কাজে লাগাবেন না, সেটা পুরোপুরিই আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি শুধু আমার নিজের মতামত বললাম এতক্ষণ। জীবনটা আপনার, সে জীবনটা কাটানোর কায়দাও আপনিই ঠিক করবেন। যত বড় বিসিএস পণ্ডিতই হোক না কেন, পরীক্ষার হলে পরিবেশ, মানসিক অবস্থা, এবং আরও কিছু পারিপার্শ্বিক কারণে উনার এবং অন্য সবার লেভেলই মোটামুটি একই জায়গায় থাকে। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা বাজবে, আপনিও জিরো থেকে শুরু করবেন, বাকিরাও জিরো থেকে শুরু করবেন। কেউই কারোর চাইতে কোনো অংশে কম না! সেই জিরোকে ২ ঘণ্টায় কে কতদূর নিয়ে যেতে পারে, তা দিয়েই ঠিক হয়ে যাবে, কে জিতবে, কে ছিটকে পড়বে!
যুদ্ধে নামুন, দেখা হবে! অপেক্ষায় রইলাম।
সুশান্ত পাল
আপনাদের সিনিয়র সহকর্মী