চারপাশটা সবুজে ঘেরা, কাঁচা রাস্তা ভাগ করেছে দুই পাশের বিস্তীর্ণ অংশকে। কোথাও আবার উঁচু-নিচু আঁকাবাঁকা টিলা। এখানে সবুজের সমারোহ দেখতে প্রতি বছরই অনেক ভ্রমণ পিপাসুরা ঘুরতে আসেন। কিন্তু তাদের অনেকেই জানেন না, পরতে পরতে সবুজ মাখানো এই বাগানের শ্রমিকদের নিদারুণ কষ্টের কথা। আধুনিক যুগে এসেও যারা মধ্যযুগীয় কায়দায় শোষণের শিকার। শ্রমিকের কান্না আর আহাজারি হয়তো ওপরের দরজায় পৌঁছায় না।
ভারতের আসামে বাণিজ্যিক চা চাষ শুরু হয় ১৮৩৯ সালে। বর্তমান সিলেট অঞ্চল তখন আসামের মধ্যে। আর তখনকার আসাম ও এখনকার বাংলাদেশে বাণিজ্যিক চা চাষের সূচনা ১৮৫৪ সালে। বর্তমানে সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার বড় বড় চা বাগানের সংখ্যা ১৫৮টি। এসব চা বাগান ১ লাখ ১২ হাজার ৭৪৫ দশমিক ১৫ হেক্টর জমিজুড়ে। এক সময় এসব চা বাগান এলাকা ছিল জঙ্গল এবং তাতে ছিল সর্বসাধারণের অধিকার। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা বসভূমির ওপর তাদের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে। আর ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলে এসব জমির মালিকানা চলে আসে রাষ্ট্রের হাতে। অর্থাৎ ঐতিহ্যবাহী চা বাগানের জমির মালিক রাষ্ট্র। প্রতিটি বাগানের মালিককে চা চাষের জমির ইজারা নিতে হয় রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এসব ঐতিহ্যবাহী চা বাগানের বাইরে সাম্প্রতিক সময়ে পঞ্চগড়ে সাতটি ও ঠাকুরগাঁওয়ে একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়া উত্তরবঙ্গে ছোট ছোট চা চাষের খামার আছে ৫ হাজার ৩৫১টি।
এসব বাগানে কাজ করেন ১ লাখ ৪০ হাজার ১৮৪ জন শ্রমিক। এদের মধ্যে উত্তরবঙ্গের ১ হাজার ৮১৮ শ্রমিক বাদে বাকি সবাই কাজ করেন ঐতিহ্যবাহী ১৫৮টি চা বাগানে। এসব শ্রমিকের মধ্যে নিবন্ধিত শ্রমিক ১ লাখ ৩ হাজার ৭৪৭ জন এবং অনিবন্ধিত ৩৬ হাজার ৪৩৭ জন। উভয় প্রকার শ্রমিকের মধ্যে পুরুষ ৬৯ হাজার ৪১৫ এবং নারী ৭০ হাজার ৭৬৯ অর্থাৎ নারী শ্রমিকের সংখ্যা পুরুষ শ্রমিক থেকে ১ হাজার ৩৫৪ জন বেশি। এ হিসাব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অধীন বাংলাদেশ চা বোর্ডের।
চা বাগানে শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে যে পাঁচ লাখের মতো মানুষ তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশের অধিক অবাঙালি। এদের জাতি পরিচয় অবাক করার মতো। সাম্প্রতিক সময়ে চা শ্রমিক হিসেবে যোগ দেয়া বাঙালি ৫ শতাংশের মতো আর বিহারি মুসলমান ৩ শতাংশের মতো। বাকিদের মধ্যে আছেন আদিবাসী ও নানা জাতিগোষ্ঠীর মানুষ। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টে (সেড) ২০১৪-১৬ সালে পরিচালিত জরিপ ফলাফল অনুসারে চা বাগানে ৮০টির মতো জাতিগোষ্ঠী আছে এবং তাদের মধ্যে প্রচলিত আছে ১৩টি ভাষা। তবে চা বাগানের শ্রমিক পরিবারগুলোর মধ্যে হিন্দু ধর্মবলম্বীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ব্রিটিশ আমলে চা বাগান শুরু করতে গিয়ে আসাম বা বর্তমান বাংলাদেশের যেখানে চা বাগান, সেখানকার মানুষদের চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য পাওয়া যায়নি। আসামের স্থানীয় মানুষ ও বাঙালিরা জঙ্গল কেটে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে চা বাগানে কাজ করার জন্য মানসিকভাবে তৈরি ছিল না। তখন চা বাগানে কাজ করার জন্য আড়কাটি, মাইস্ত্রি এবং সরদার বলে পরিচিত দালাল শ্রেণীর লোকদের লাগানো হলো শ্রমিক সংগ্রহের কাজে। তারা বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, পশ্চিম বঙ্গ ও উত্তর প্রদেশসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে শ্রমিক সংগ্রহের কাজে লেগে গেল। যাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে চা বাগানে কাজ করার জন্য আকৃষ্ট করা হলো, তারা মূলত হিন্দুদের চার বর্ণের বাইরে পঞ্চম শ্রেণীর মানুষ ও আদিবাসী। ভারতবর্ষে এরা অস্পৃশ্য, দলিত, হরিজন, ট্রাইবাল এসব শব্দ দ্বারা পরিচিত। তারা যখন পরিবার-পরিজন নিয়ে দলে দলে চা বাগানগুলোতে এল, তখন তারা বুঝতে পারল তাদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু ইংরেজ সাহেবরা এবং তাদের সহযোগিরা এদের নানা কৌশলে চা বাগানে আটকে দিল।
আজকে আমরা যেসব সুদৃশ্য চা বাগান দেখি তা সে সময় ছিল বাঘ, ভাল্লুক, বিষধর সাপ, মশা ও জোঁকসহ নানা বন্য প্রাণীতে পরিপূর্ণ। বিপুলসংখ্যক শ্রমিক মারা গেল জঙ্গল পরিষ্কার করে বাগান তৈরি করতে। তারা ব্রিটিশ সাহেবদের জন্য ও তাদের ম্যানেজারদের জন্য তৈরি করল সুদৃশ্য সব বাংলো। কিন্তু তাদের নিজের ঠাঁই হলো শ্রমিক কলোনির মাটির ঘরে। সেখানে তাদের পরিবার-পরিজনের একটা বড় অংশ ডায়েরিয়া, কলেরা, গুটিবসন্তসহ নানা রোগ-শোকে মারা পড়ল। আজ আমরা যখন চা বাগানগুলোয় যাই, একই দৃশ্য দেখি। চা বাগানের ম্যানেজাররা বাস করেন সুদৃশ্য ও বিশালবহুল বাংলোয়। একজন ম্যানেজারের দেখাশোনার জন্য কুড়িজন পর্যন্ত নারী-পুরুষ শ্রমিক কাজ করেন। আর শ্রমিকরা বাস করেন লেবার লাইন বা শ্রমিক কলোনিতে, যেখানে অধিকাংশ ঘর কাঁচা ও নিম্নমানের।
চা বাগানে যে শ্রমিক বিরতিহীনভাবে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন, চা উৎপাদনের জন্য তারাই বাঁচিয়ে রেখেছেন চা শিল্পকে। ব্রিটিশ আমলে তাদের বলা হতো ‘কুলি’। বর্তমানেও তারা অনেকটাই অস্পৃশ্য হিসেবে বিবেচিত। তার পরও বাগানের ম্যানেজার ও মালিক তাদের কাছে ‘মা-বাপ’।
কিন্তু চা শ্রমিকরা যে এত শ্রম দিয়ে মালিক-ম্যানেজারকে বিলাসবহুল জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন, তার বিনিময়ে তারা কী পাচ্ছেন? আজকে দেশব্যাপী মানুষ মনের আনন্দে চা পান করে। কিন্তু চা শিল্পকে বাঙালি নয় এসব শ্রমিক চাঙ্গা করে রেখেছেন। বিনিময়ে তারা কী পাচ্ছেন?